গল্পের পূর্ণ অবয়ব-যুক্ত রূপকে আমরা সাধারণত উপন্যাস বলে থাকি।মানুষের গল্পের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ চিরন্তন সেই আদিম যুগ থেকে, যা ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পর উপন্যাসের রূপ লাভ করে। ঔপন্যাসিক যখন তার ব্যক্তিগত ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাসকে ভালোবাসার মোড়কে সাহিত্যের রূপ দিতে চেষ্টা করেন তখন একটি রোমান্টিক উপন্যাস সৃষ্টি হয়।
একটি রোমান্টিক উপন্যাস প্রাথমিকভাবে দুজন মানুষের ব্যক্তিজীবনের গল্প। যেখানে ভালোবাসার ভাবাবেগ পূর্ণ আত্মতুষ্টিমূলক মধুর অনুভূতি প্রকাশ পায়। ফলস্বরূপ রোমান্টিক উপন্যাসের পাঠকবর্গ আশা করেন এই ধরনের উপন্যাসের মূল উপাদান হবে দুজন ব্যক্তির রাগ-অনুরাগ ও তাদের প্রণয়লীলা কাহিনী।
রোমান্টিক উপন্যাস লেখার কিছু সহজ পদ্ধতি হল নিম্নরূপ –
রোমান্টিক উপন্যাসে পূর্বরাগ ও তারপর প্রেম নিবেদন-
এই ধরনের উপন্যাস কিছু বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্য ও পদ্ধতির দাবি করে। রোমান্টিক উপন্যাস-এ প্রাথমিক পর্বে দুজন কেন্দ্রীয় চরিত্রের মধ্যে পূর্বরাগ ও তারপর প্রেম নিবেদনের মাধ্যমে একটি প্রনয়ের সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে কাহিনীর সূত্রপাত হতে পারে।
উপন্যাসের সাব-প্লট গুলির মূল সাথে সংযুক্তিকরণ
রোমান্টিক উপন্যাসের বিষয়বস্তুর অগ্রগতি, চরিত্রায়ন এবং ক্লাইম্যাক্স নভেলএর মূল বিষয় রোমান্সের সাথে সম্পর্কিত হওয়া বিশেষ ভাবে কাম্য।যদিও রোমান্টিক উপন্যাসের অনেক সাব-প্লট থাকতে পারে এবং তারা সরাসরিভাবে রোমান্সের সাথে সংযুক্ত নাও হতে পারে তবে তা নভেল একটা আলাদা মাত্রা যোগ করে।এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে তা যেন কখনোই কাহিনীর মূল বিষয় থেকে সম্পূর্ণভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে।
রোমান্টিক উপন্যাস মানে নায়ক-নায়িকার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লড়াই-
আবার অন্যদিকে একটি রোমান্টিক উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে একটা সাধারণ প্রারম্ভিক প্লটও থাকতে পারে। যেখানেই উপন্যাসের নায়ক এবং নায়িকা একটি অনুরাগের সম্পর্কে আবদ্ধ থাকেন এবং পরবর্তীতে গল্প অন্যদিকে বাঁক নেয়,সেখানে কিছু এমন ব্যক্তিদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয় যারা ভালবাসার প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব পোষণ করে এবং পরবর্তীতে নায়ক ও নায়িকার চরিত্র দুটি এই বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন।
রোমান্টিক উপন্যাস পাঠকদের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক-
এক্ষেত্রে মূলত দুজন মানুষের ভালোবাসার সম্পর্ককে উদযাপন করা হয়। পরবর্তীতে মূল কাহিনীর অগ্রগতি ঘটে নায়ক-নায়িকার ভালোবাসার সুখানুভূতি তথা তাকে কেন্দ্র করে একে অপরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনের মাধ্যমে। প্রকৃতপক্ষে পাঠক তাদের নিজেদের জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা গুলি পূরণ করতে চান রোমান্টিক উপন্যাস পাঠের মাধ্যমে, তাই এই ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের সতর্ক দৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী।
রোমান্টিক উপন্যাসের রোমাঞ্চকর পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে পার্শ্বচরিত্র গুলির উপস্থিতি-
বস্তুতপক্ষে রোমান্টিক কাহিনীর আরেকটি প্রেক্ষাপট রয়েছে,যেখানে মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে কেন্দ্রীয় চরিত্রের সম্পর্ক গুলি একটা নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে প্রতিফলিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।না হলে গল্পটি একপেশে ও একঘেয়ে হয়ে যেতে পারে,যা পাঠকের ভালো নাও লাগতে পারে।গল্পে রোমাঞ্চকর পরিস্থিতি তৈরি করার ক্ষেত্রে পার্শ্বচরিত্র গুলির প্রতিও লেখক-এর বিশেষ সুবিচার কাম্য।
রোমান্টিক উপন্যাস ও ব্যভিচার মূলক দৃষ্টিকোণ-
কতিপয় পাশ্চাত্যের ঔপন্যাসিকগণের মতানুসারে রোমান্টিক উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট মাপকাঠি থাকা উচিত,যেখানে একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র বা প্রোটাগনিস্ট থাকে এবং তাদের মতে ভালোবাসার সাথে ব্যভিচারকে যুক্ত করা কখনোই শ্রেয় নয়।
রোমান্টিক উপন্যাসের গল্পের মূল থিম রাখাই শ্রেয়-
একজন রোমান্টিক উপন্যাসের গল্পকার যেকোনো স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে তার কাহিনী পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি করতে পারেন। আধুনিককালে রোমান্টিক উপন্যাস গুলি কোন নির্দিষ্ট নিয়মে আবদ্ধ নয় তাদের পরিসর অনেক বিস্তীর্ণ। তাই এক্ষেত্রে বলা যায় গল্পের মূল থিম সঠিক রেখে যেকোনো ভাবে গল্পকার তার গল্প কে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে।
রোমান্টিক উপন্যাস ও বিভিন্ন বিতর্কিত পরিপ্রেক্ষিত-
বর্তমান উদারনৈতিক যুগে আমরা রোমান্টিক উপন্যাসে বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয় যেমন-গার্হস্থ্য হিংসা, বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের উপস্থিতি, সমকামিতা ইত্যাদি দেখতে পাই যা পাঠকরা আধুনিকমনস্ক হয়েই গ্রহণ করেছেন।
রোমান্টিক উপন্যাসে ইরোটিক ও তাত্ত্বিক প্রেমের মেলবন্ধন-
এক্ষেত্রে একটি বিষয়ে আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয়। আধুনিককালের রোমান্টিক ঔপন্যাসিকরা ইরোটিক প্রেম ও স্পর্শহীন তাত্ত্বিক প্রেম দুই-এরই সহাবস্থান ঘটিয়েছেন তাদের কাহিনীতে। তাই আমরা সহজেই বলতে পারি আধুনিককালের ভালোবাসার গল্প এই দুই বিবিধ চরমপন্থার মধ্যে সেতুবন্ধন করেছে।
সর্বোপরি বলা যায় রোমান্টিসিজম হল এমন একটা বিষয় যেখানে লেখক-এর ভাব কল্পনা ও উচ্ছ্বাস একটি মনোরম মধুর ভঙ্গিতে বিভিন্ন ইতিবাচক শব্দের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়,যা সমকালীন সমাজের ভালোবাসার ভাবধারার প্রতিফলন ঘটায়। প্রেম-ভালোবাসার গ্রহণযোগ্যতা ও আত্মপ্রকাশ বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রকম। সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাথে সাথে রোম্যান্টিসিজমের গ্রহণযোগ্যতার পরিবর্তন ঘটেছে।
রবীন্দ্রনাথের ”শেষের কবিতা”; ”চোখের বালি” তারপর শরৎচন্দ্রের ”দেবদাস”; ”পরিণীতা” আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে যা সর্বকালের সেরা উপন্যাস তারপর মৈত্রেয়ী দেবী ”ন হন্যতে’’;সুচিত্রা ভট্টাচার্য্য-এর‘’বসন্তের পাখি’’ এবং বুদ্ধদেব গুহর ”একটু উষ্ণতার জন্য” রোমান্টিক উপন্যাস গুলির মধ্যে বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। এই উপন্যাস গুলির বিস্তারের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কালে ভালোবাসার পরিবর্তিত রূপ ও তার গ্রহণযোগ্যতা পরিবর্তন ঘটেছে।
সর্বশেষে বলা যায় একটি ভালো রোমান্টিক নভেল সেটাই যা পাঠকের মানসিক চাহিদা কে পরিতৃপ্ত করে এবং অন্যান্য পরিপ্রেক্ষিত ও পার্শ্বচরিত্র দের সঙ্গে করে পথ চলা শুরু করলেও উপন্যাসে রোমান্টিসিজমকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়।